জবাবদিহি ও দায়িত্ব
ইংরেজি সংস্করণ | ফরাসি সংস্করণ | হিন্দি সংস্করণ | পর্তুগিজ সংস্করণ | স্প্যানিশ সংস্করণ
ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে ভারতের বহু লোকেই সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে অধিকতর জবাবদিহি চেয়ে থাকেন। যে বিধবা তাঁর পেনশনের দরখাস্তটার কী হল, সে সম্পর্কে কোনো খবর পান না, যে সাফাই কর্মী মাসের পর মাস তাঁর মজুরি পাননি, যে অসহায় মানুষটি ন্যায্য মাসুলের অঙ্ক বহু গুণ বাড়িয়ে পাঠানো বিদ্যুতের বিলের চোটে জেরবার, যে ট্রাক-চালক দুর্নীতিগ্রস্ত ট্যাক্স অফিসারের তোলাবাজির শিকার— এঁদের সকলের একটাই চাওয়া: সরকারি কর্মচারী ও প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজেদের কর্তব্য পালনের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন।
এ-বিষয়ে অনেক কথা হয়েছে, কিছু কাজও হয়েছে। সরকারি কর্তৃপক্ষের জবাবদিহির ব্যাপারে ২০০৫ সালে পাশ হওয়া তথ্যের অধিকার আইনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। সরকারি জবাবদিহিকে আদালতে বলবৎ করে সরকারি কাজে স্বচ্ছতার মানে একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছে এই আইন। কিছু কিছু রাজ্য তো অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য উন্নততর ব্যবস্থাও করেছে, এমনকি নতুন আইনও এনেছে।
কিন্তু, গত দশ বছরে ঘড়ির কাঁটাকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারতে এখন যারা ক্ষমতায় আসীন তারা নাগরিকদের কাছে সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার বদলে সরকারের কাছে নাগরিকদের জবাবদিহি আদায় করতেই বেশি তৎপর। অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানকেই সরকারের আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত করা হয়েছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে জবাবদিহি বাড়িয়ে তোলার জন্য নেওয়া বিভিন্ন নতুন উদ্যোগে নিশ্চয়ই কিছুটা কাজ হতে পারে। কিন্তু জবাবদিহির যোগ হল সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের সঙ্গে— এগুলোর কাজ থেকে সর্বসাধারণের যে-সব সুফল হওয়ার কথা তা যে তাঁরা সত্যই পাচ্ছেন, তা নিশ্চিত করার সঙ্গে। তাই, জবাবদিহির নিজস্ব সীমাবদ্ধতা থেকেই যায়। কার্যত জবাবদিহির ব্যাপারটা কাজ করে পুরস্কার ও শাস্তির বন্দোবস্তের মাধ্যমে সরকারি কর্মচারীদের কিছু পূর্ব-নির্দিষ্ট কাজ ঠিকমতো করানোর মধ্য দিয়ে। অথচ, সরকারি কর্মচারীদের অনেক কাজকর্মকেই একেবারে নীচের স্তর পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। যদি তা সম্ভব হয়ও, তা হলেও লোকেদের কাজ করতে দেওয়া এবং সেগুলো যাতে ঠিকমতো করা হয়ে ওঠে তা তদারকি করার পূর্বনির্ধারিত কোনো ব্যবস্থা খুব একটা ফলপ্রসূ হয় না। তা ছাড়া, ‘পুরস্কার ও শাস্তি’-র ব্যাপারটা একটা সীমিত পরিসরে কাজ করে, এর মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর নিজস্ব উদ্যোগ ও সৃষ্টিশীলতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ থাকে না।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনো স্কুলশিক্ষকের হাজিরার ওপর নজরদারি হয়তো সম্ভব, কিন্তু তিনি স্কুলে হাজির থাকলেই যে যথেষ্ট নিষ্ঠা ও উদ্যমের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের পড়াচ্ছেন, সেটা নিশ্চিত করা যাবে কীভাবে? কেউ কেউ এটার একটা গোদা উত্তর দিয়েছেন: ছাত্রছাত্রীরা কতটা কী শিখছে তার ভিত্তিতে শিক্ষকদের মাইনে দেওয়া হোক। কিন্তু স্কুল তো কেবল কোচিং সেন্টার নয়। শিক্ষার মান লেখাপড়া ছাড়াও অনেক কিছুর সঙ্গে যুক্ত, যেমন, তাদের জীবনকুশলতা, সক্ষমতা, আচরণ, মূল্যবোধ, এবং সর্বাঙ্গীণ বিকাশ। জবাবদিহি সংক্রান্ত কিছু ব্যবস্থা হয়তো উৎকৃষ্ট মানের শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে নিয়ে যায়, কিন্তু এদের সব ক’টিরই সীমাবদ্ধতা আছে। একটা কথা তো ঠিক— শিক্ষক ঠিক কী করছেন, সেটাই বাইরের কোনো লোকের পক্ষে এসে বুঝে ওঠা সম্ভব সম্ভব না, তাঁর কাজের কী ফল পাওয়া যেতে পারে সেই বিচার তো অনেক দূরের ব্যাপার।
আমাদের এটা মানতেই হবে যে, দায়িত্ব পালন করা অনেক প্রশস্ত ব্যাপার, জবাবদিহি হল তার একটা মাত্র দিক। এটা ঠিক যে অন্যের কাছে জবাবদিহি করতে হবে বলে কোনো শিক্ষক নিজের কাজে দায়িত্বশীল হতে পারেন। কিন্তু, বাচ্চাদের সক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করার তাগিদে, একজন ভাল শিক্ষক হিসেবে নিজের অন্তর থেকে উঠে আসা প্রেরণার কারণেও তিনি দায়িত্বের সঙ্গে কাজ করতে পারেন। অন্য একটা উদাহরণ নেওয়া যাক: গাজাতে যে অগণন ডাক্তার, সাংবাদিক ও ত্রাণকর্মী আহতদের চিকিৎসা করা, বিভিন্ন ঘটনাকে খবরে তুলে আনা, এবং ক্ষুধার্তদের খাবার জোগানোর কাজে লেগে আছেন, তাঁরা তো জবাবদিহির দায়ে এই সব কাজ করছেন না! অনবরত মুড়িমুড়কির মতো বোমাবাজি চলছে— কখনো কখনো তাঁদের ওপরেও বোমা পড়ছে— এরই মধ্যে তাঁরা যে কাজ করে চলেছেন সেটা তাঁরা করছেন গাজার মানুষের প্রতি তাঁদের দায়িত্বশীলতা অথবা নিজস্ব পেশাগত নৈতিকতা থেকে।
জবাবদিহি ও দায়িত্বশীলতার মধ্যে পার্থক্য করাটা অন্তত দুটো কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, সামাজিক প্রগতিতে দায়িত্ববোধ একটা বিরাট শক্তি হিসেবে কাজ করে। জবাবদিহি লোকেদের দিয়ে সেই কাজটা করিয়ে নিতে পারে যেটা অন্যেরা তাদের দিয়ে করাতে চাইছে; এবং এটা ততখানিই করিয়ে নেওয়া যায় যতটা নজরদারির মধ্য দিয়ে করানো সম্ভব। অন্য দিকে, দায়িত্ববোধ হল সেটাই, যা লোকেরা জনস্বার্থের কথা ভেবে নিজেদের ভিতর থেকে আসা তাগিদে করতে চায়। এই আন্তরিক তাগিদ উদ্যোগ ও সৃষ্টিশীলতাকে বিপুল রসদ জোগায়, যেটা জবাবদিহির আওতায় পড়ে না। বস্তুত, গোটা বিশ্বে যে সব প্রতিষ্ঠান ভালভাবে সচল, সেগুলোর পিছনে একটা প্রধান ভূমিকা পালন করেছে দায়িত্বশীলতার সংস্কৃতি। এটা শুধু স্কুলের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, হাসপাতাল, গ্রন্থাগার, সংগ্রহশালা, আদালত থেকে শুরু করে সংসদ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারেই তা দেখা যায়।
দ্বিতীয়ত, জবাবদিহি ও দায়িত্ব পালনের জন্য কী উপায় নেওয়া হচ্ছে তার ভিত্তিতেও এই দু’টির মধ্যে প্রভেদ দেখা দেয়। যেমন, যেখানে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে, সকলেই ঠিক সময়ে দফতরে হাজিরা দেবে, সেখানে কারো পক্ষে সময়ানুবর্তিতার অভ্যাস গড়ে তোলাটা সহজ হয়ে ওঠে। এখানে জবাবদিহি ও দায়িত্ববোধ একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু, এ দুটো আবার একেবারে বিপরীত দিশায় কাজ করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে, কাজের জায়গার পরিবেশটা যদি পদানুসারী হয়, সেখানে জবাবদিহি কাজ করতেই পারে, কিন্তু নিচু পদে কাজ করা লোকেরা তাগিদ হারিয়ে ফেলতে পারে, ফলে দায়িত্বশীলতা নষ্ট হয়ে যায়। তেমনি, কেন্দ্রীকরণ থেকে জবাবদিহি বাড়তে পারে, কিন্তু দায়িত্বশীলতা বাড়ে বিকেন্দ্রীকরণের মধ্য দিয়ে। দুটোর মধ্যে পরিপূরকতা থাকলেও, এ দুটোর পরিসর কিন্তু একেবারে আলাদা।
সংবিধান রচনার জন্য গঠিত গণপরিষদে জয়পাল সিংহ মুণ্ডা ছিলেন আদিবাসীদের অগ্রণী মুখপাত্র, পরে তিনি স্বাধীন ভারতের ক্রীড়া মন্ত্রীও হন। তিনি জবাবদিহি সংক্রান্ত কোনো পদক্ষেপ না করেও দায়িত্ব সম্পর্কিত মূল্যবোধ বাড়িয়ে তোলার একটা চমৎকার উদাহরণ তুলে ধরেছিলেন। ক্রীড়া মন্ত্রী থাকাকালীন তিনি সংসদের শাসক ও বিরোধী— দু’পক্ষের সদস্যদের নিয়ে একটা ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করেন। এর মধ্যে দিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে একটা ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়। জয়পাল সিংহের নিজের কথায়, “এই ম্যাচ, ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে একসঙ্গে বসে মধ্যাহ্নভোজ এবং নৈশাহার— এগুলো থেকে প্রাপ্তির দিকটা বেশ বড়। এটা সব দলগুলোকে একত্র করে এবং সংসদের দুই কক্ষেই বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ গড়ে তোলে।” সংসদে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ’ গড়ে তোলাটা কেবল সংসদকে মনোরম করে তোলার ব্যাপার ছিল না, সংসদের কাজকর্ম ভালভাবে চলার জন্য এটা জরুরি ছিল। দুর্ভাগ্যের কথা, আজ সেই পরিবেশের কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই।
ওপরের কাহিনিটি থেকে আমরা বুঝতে পারি, দায়িত্বের মধ্যে প্রায়শই একটা সহযোগিতার দিক থাকে। নীতিনিষ্ঠ কোনো লোক অবশ্যই সব সময় দায়িত্ববানের মতোই কাজ করে যাবেন, তা অন্যেরা যা-ই করুক না কেন। যেমন, অন্যেরা ট্র্যাফিক সিগন্যাল না মেনে রাস্তা পার হলেও তিনি কিন্তু সিগন্যাল সবুজ হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকবেন। কিন্তু, বেশির ভাগ লোকের পক্ষেই দায়িত্বশীল আচরণ করাটা তখন সহজ হয়, যখন অন্যরাও সেটা করছে।
এই মৌলিক পর্যবেক্ষণটির একাধিক সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য আছে। তার একটা হচ্ছে এই যে, দায়িত্ববোধহীনতা প্রায়ই আমাদের এমন একটা ‘সামাজিক ফাঁদ’-এর মধ্যে ফেলে দেয়, যেখানে লোকেরা একটা দায়িত্বশীল পরিবেশের মধ্যে থাকতে চেয়েও অন্যদের দায়িত্বহীনতার অনুকরণ করে। ভারতে বহু স্কুলই এইরকম একটা ফাঁদে পড়েছে বলে মনে হয়। মুদ্রাটির একটি অন্য পিঠ আছে: সামূহিক প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে এই ফাঁদটিকে এড়ানোর মধ্য দিয়ে আমরা অনেক কিছু পেতে পারি। এখানে একটা স্বতঃসিদ্ধ স্থায়িত্বের ব্যাপারও আছে, যেখানে বিভিন্ন লোকের দায়িত্বশীল আচরণ অন্যদের দায়িত্বশীলতা বাড়িয়ে তোলে। সামাজিক বিধি নিয়ে লেখাপত্রের মধ্যে এরকম ‘বহুবিধ সমস্থিতি’-র উদাহরণ পাওয়া যায়।
আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে, নির্বাচনী গণতন্ত্রের পুরো ইমারতটাই দাঁড়িয়ে আছে একটা সাধারণ সহযোগিতামূলক দায়িত্ব পালনের ওপর: সেটা হল ভোটদান। সব ভোটারই জানে, তার ভোট এককভাবে কোনো বদল আনতে পারবে না। তা সত্ত্বেও বহু লোকে— প্রায়শই ব্যাপক সংখ্যাগুরু অংশ— অনেক সময়ই অনেকটা পথ হেঁটে যাওয়া বা দীর্ঘক্ষণ কাতারে দাঁড়িয়ে থাকার মতো সমস্যার মধ্যেও ভোট দিয়ে থাকে। ভোট দেওয়ার পিছনে নানা উদ্দেশ্য কাজ করতে পারে, কিন্তু অনেক লোকেই স্রেফ মনে করে যে ভোট দেওয়াটা হচ্ছে দায়িত্বশীল নাগরিকের কর্তব্য।
একটি সুস্থ সামাজিক জীবনের জন্য দায়িত্বশীলতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে চিন্তানুশীলকরা বহু যুগ ধরে আলোচনা করে এসেছেন— তাঁদের মধ্যে আছেন বেশ কিছু অর্থশাস্ত্রীও। দ্য থিয়োরি অব মরাল সেন্টিমেন্টস বইতে অ্যাডাম স্মিথ জোর দিয়ে বলছেন, আমরা যা যা করে থাকি তা কেবল আমাদের নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যই করি না; অন্যেরা আমাদের কাজকর্মকে কোন চোখে দেখছে সেই আত্মসমীক্ষণ থেকে উঠে আসা “আচরণের সাধারণ নিয়মাবলি”-র দ্বারাও আমাদের সেই কাজগুলি প্রভাবিত হয়ে থাকে। আলফ্রেড মার্শালকে নব্য ধ্রুপদী অর্থশাস্ত্রের জনক বলা হয়ে থাকে। তাঁর অসামান্য গ্রন্থ প্রিন্সিপলস অব ইকনমিকস-এ তিনি ‘অ-স্বার্থপর আচরণ’-এর শক্তি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। এমনকি তিনি লিখেছেন, “অর্থশাস্ত্রীর চূড়ান্ত লক্ষ্য হল, কীভাবে লীন হয়ে থাকা এই সামাজিক সম্পদটিকে বিকশিত করা যায়— তা আবিষ্কার করা।” ডঃ বি আর আম্বেদকরের বিবেচনায়, ‘ভ্রাতৃত্ব’ ব্যতিরেকে স্বাধিকার ও সাম্য “কোনো স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবে” আসে না। ভ্রাতৃত্ব হচ্ছে দায়িত্বশীলতার এমন এক শক্তিশালী রূপ, যা “ব্যক্তিবিশেষকে অন্যদের শুভময়তার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেখতে” শেখায়। এ-কথা ঠিক যে, আজকের মূলধারার অর্থশাস্ত্রে, ‘হোমো একনোমিকাস’-এর মন্ত্রে, মানুষের স্বার্থসর্বস্বতার জয়গানের মধ্যে, অ-স্বার্থপর চিন্তাগুলো গুরুত্ব হারিয়েছে, কিন্তু তাদের প্রাসঙ্গিকতা লুপ্ত হয়ে যায়নি। আমাদের পূর্বজ অর্থশাস্ত্রীরা যা জেনেছিলেন, আমরাও সেটা জানতে পারি।
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, কলকাতা থেকে প্রকাশিত দ্য টেলিগ্রাফ দৈনিকে প্রকাশিত মূল ইংরাজির বাংলা তর্জমা ।
ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদের জন্য কুমার রাণা ধন্যবাদার্হ।